Month: October 2017

কোরিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা

কোরিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা

এক

গতমাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন থেকে ফিরে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক প্রেসিডেন্ট অফিসের বিশেষায়িত ১১টি দপ্তরের প্রধানদের সাথে একটি বৈঠক করেন। প্রেসিডেন্ট অফিসের ফেসবুক পেইজ এবং ওয়েবসাইটে সে বৈঠক সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। নিচের ছবিটি ঐ বৈঠকের ছবি। এই ১১টি দপ্তর কোরিয়ার পলিসি তৈরী করতে প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা করে থাকে। প্রেসিডেন্ট কোরিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে কিছু করতে গেলে এই দপ্তরগুলোর সহযোগিতা নেয়। প্রেসিডেন্ট প্রতিবারের মত এবারও জাতিসংঘ সফর শেষে জাতিসংঘে কোরিয়ার ভূমিকা কি হবে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে কোন কোন অবস্থান থেকে নেতৃত্ব দিবে এইসব নিয়ে জাতিসংঘে যেসব কাজ করে এসেছেন তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট অফিসের দপ্তর প্রধানদের সাথে আলোচনা করেন।

এই এগারটি দপ্তরের প্রধানদের সবাই নিজ নিজ দপ্তরের কাজের উপর স্পেশালিষ্ট। দপ্তর প্রধানদের প্রোফাইল খুঁজে বের করে দেখলাম ১১জনের মধ্যে ৫জন কোরিয়ার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, ১জন এমপি, ১জন সাবেক বিচারপতি, ১জন সাবেক কূটনীতিক, ১জন সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা, ১জন একটি এনজিও প্রধান এবং সর্বশেষ ১জন একটি মিডিয়া হাউজের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। অর্থাৎ ১১জনের মধ্যে ৫জনই প্রফেসর, বাকী ৬জনের পেশা ভিন্ন।

ছবিতে প্রেসিডেন্টের ডানপাশের ভদ্রলোক আমার ডিপার্টেমেন্টের প্রফেসর ছিলেন। তিন সেমিস্টারেই উনার কোর্স নিয়েছিলাম। আমার এডভাইজার প্রফেসরের বন্ধু হওয়ায় আমার থিসিসও তদারকি করেছেন তিনি। উনার কাজের একটা উদাহরণ দেই। উনি আমার থিসিস প্রথম এবং দ্বিতীয় এডিট দুইবারই লাইন বাই লাইন পড়েছেন এবং দাগ দিয়ে ভুল ধরেছিলেন। ক্লাসে পড়াতেনও অসাধারণ। উনি এর পাশাপাশি কোরিয়া ট্রেড কমিশনের প্রধান ছিলেন। বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত ছিলেন। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের আগে কোরিয়া ডিভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটেরও (Korea Development Institute-KDI) এরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। উনার সম্পর্কে এত কিছু বলার কারণ হলো উনার ইনকাম সোর্স সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া। এই ব্যাপারে একটু পরে আলোচনা করছি।

দুই

কোরিয়ার সরকারী একটি গবেষণা সংস্থার জরিপে এই বছরের শুরুর দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার মাধ্যমিকের ৬২ হাজার ২০৩ জন এবং হাইস্কুলের ৪৪ হাজার ৯৩৭ জন ছাত্রছাত্রীকে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা ভবিষ্যতে কি হতে চায়। জবাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী (মাধ্যমিক স্কুল পড়ুয়ার ২৮.৩ শতাংশ এবং হাইস্কুলের ২৪.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী) জানিয়েছিল পেশাগত জীবনে তারা শিক্ষক হতে চায়। অর্থাৎ জরিপ অনুযায়ী প্রায় এক চতুর্থাংশ ছাত্রছাত্রী ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চান। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ ধরণের কোন জরিপ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে হয়ে থাকলে পেশার দিক দিয়ে প্রথমেই আসবে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার।

আমার পরিচিত এক কোরিয়ান কোম্পানীর প্রেসিডেন্টের দুই ছেলের প্রথম ছেলে একজন ইঞ্জিনিয়ার (আমেরিকায় মাইক্রোসফটে কর্মরত) এবং দ্বিতীয় ছেলে দুই বছর আগে একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। স্কুলে চাকরি শুরুর আগে একদিন কথা প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার বাবার এত বড় ব্যবসা ফেলে সে কেন শিক্ষক হতে চায়? তার উত্তরে সে বলেছিল কোরিয়াতে সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা শিক্ষকতা। আরো বড় বড় বেশকিছু চাকরির সুযোগ থাকা স্বত্বেও সে তাঁর স্বপ্নের চাকরি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছে।

তিন

এবার আসি কোরিয়ায় পেশা হিসেবে শিক্ষকদের অবস্থান কি। প্রথমে আসি বেতন প্রসঙ্গে। কোরিয়ায় একজন সরকারী অফিসার ৯গ্রেডে (আমাদের দেশে বিসিএস কর্মকর্তা) একজন কর্মকর্তা চাকরি শুরু করে ৩৫লাখ ১১হাজার উওন দিয়ে অর্থাৎ ২লাখ ৩৪হাজার টাকায় (২০১৫সালের তথ্যানুযায়ী)। আর একজন লেকচারার শুরু করে প্রায় ৪০লাখ উওন অর্থাৎ ২লাখ ৬৭ হাজার টাকায় (এইটা সরকারী হিসাব অনুযায়ী। গড় হিসাব কারণ ইউনিভার্সিটিগুলো নিজেরাই বেতন নির্ধারণ করে থাকে)। সরকারী কর্মকর্তা চাকরির শেষ পর্যায়ে বেতন পান ৬০ লাখ ৭০হাজার উওন অর্থাৎ ৪লাখ ৫হাজার টাকা। অন্যদিকে একজন প্রফেসর পান ৭৫লাখ ৯০হাজার উওন অর্থাৎ ৫লাখ ৬হাজার টাকা।

উপরের তথ্য শুধু বেতন নিয়ে। একজন সরকারী কর্মকর্তা বেতনের বাইরে তেমন কোন আয়ের সুযোগ নেই। সপ্তাহে পাঁচদিন তাকে অবশ্যই কাজ করতে হয়। অন্যদিকে সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রফেসরদের প্রজেক্ট থেকে আয় হয় বেতনের চেয়েও বেশি। আর কমার্স বা হিউমিনিটিসের প্রফেসরদেরও বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ থাকে। এইসব ডিপার্টেমেন্টের প্রফেসররা সপ্তাহে অফিস করে মাত্র দুই থেকে তিনদিন। অন্যান্য দিন হয়ত গবেষণা করেন বা অন্যকিছু ব্যস্ত থাকেন। উপরে আমার একজন প্রফেসরের যে বর্ণনা দিলাম সেভাবে অন্যান্য প্রফেসররা বিভিন্ন কিছুর সাথে জড়িত থাকেন। যেখান থেকে আর্থিক সুযোগ সুবিধা আসে।

আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। স্যামসাং থেকে শুরু করে বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কর্তাদের ক্লাসও নেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা। আমার কোম্পানীর একটা ট্রেনিংএ একজন প্রফেসর ক্লাস নিয়েছিলেন ৪ঘন্টার জন্য। আমি আমার এক কলিগকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উনাকে কত সম্মানি দেওয়া হতে পারে। উনি বলেছিল সাধারণত প্রফেসররা ঘন্টা প্রতি ৩থেকে ৪লাখ উওন পান। সেই হিসেবে ঐ প্রফেসর ৪ঘন্টার জন্য ১২লাখ উওন থেকে ১৬ লাখ উওন (৮০হাজার টাকা থেকে ১লাখ ৭হাজার টাকা) পাওয়ার কথা।

আবার আসি ক্ষমতা প্রসঙ্গে। কোরিয়াতে যারা মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি করেন তাদের মুখে একটা কথা প্রায় শুনা যায় তা হলো কোরিয়াতে প্রফেসররা হলো গড। তারা যা চান তাই করতে পারে। কোরিয়ান সরকার বা রাষ্ট্র তাদেরকে সেই ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সরকারী লোকজন কেউই প্রফেসরদের বিরুদ্ধে খুব একটা কিছু করতে পারেনা।

পরিশেষে,

আমাদের দেশে শিক্ষকদের অবস্থান কোথায়? আমরা সবাই জানি। বেশিরভাগ শিক্ষকই আর্থিক কষ্টে থাকেন। অন্তত সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে উপহার দেওয়ার মত উনাদের টাকা থাকেনা। আমরা চলছি উদ্দেশ্যবিহীন। আমি শিক্ষক নই। আমার পরিবারে কেউ শিক্ষকও নেই। কিন্তু আমার এবং আমার মত সাধারণ সব মানুষের শিক্ষদের প্রতি এখনো অন্যরকম শ্রদ্ধা আছে। কারণ এই শিক্ষকদের হাতেই আমাদের হাতেখড়ি। উনাদের মতামতে ভিন্নতা থাকলেও চুরি করার মতো মানসিকতা থাকেনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টেমেন্টের প্রায় ২৫/৩০জন শিক্ষক দেখেছি যাদের বেশিরভাগই ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন কিন্তু তারা খারাপ কখনোই শেখান নাই। খারাপ করতে দেখিনাই। তবে ৫/১০শতাংশ আছেন যাদেরকে আমি শিক্ষক বলিনা। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর ক্যাডার। এই ৫/১০ শতাংশের জন্য কেন শিক্ষকদেরকে অপমান করব?

প্রধানমন্ত্রী গতমাসে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকদের সম্পর্কে বলেছেন ‘আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে কেন? আমার এখানে হস্তক্ষেপ করার কিছু নেই। ৯১ শতাংশ বেতন বাড়িয়েছি। কেউ কি কখনো কল্পনা করেছে, এই শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করেন। কখনো কেউ চিন্তা করেছে? আমি মনে হয়, একটু বেশি দিয়ে ফেলেছি। কমিয়ে দেওয়াই বোধ হয় ভালো ছিল।’

শুধু এতেই উনি থামেননি। শিক্ষকদের উদ্দেশ করে আরো বলেছিলেন, ‘ওনারা সচিবদের সঙ্গে তুলনা করছেন। আচ্ছা সচিবরা কী কী সুবিধা পাচ্ছেন আর ওনারা কী কী ভোগ করছেন তার একটা তুলনামূলক চিত্র লেখেন না। কোনো সচিব কিন্তু অন্য কোথাও চাকরি করতে পারেন না। সেটা জানেন ভালো করে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকেরা পারেন। কোন ইউনিভার্সিটির কত শিক্ষক কোন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করেন সে হিসাব কিন্তু আমার কাছে আছে।’

শিক্ষকদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যদি এমন মূল্যায়ন হয় তবে আমরা কিভাবে দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো। তারপরও আশা নিয়েই থাকতে হবে। একদিন হয়ত এই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের পাঁচজন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হবেন। দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশকে এই শিক্ষকরাই অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। যদিও ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো। তারপরেও আমরা আশাবাদী মানুষ। আশা নিয়েই থাকি। স্বপ্ন দেখেই যাই। বাস্তব হোক আর না হোক।

২২ অক্টোবর, ২০১৫